রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফগান জিহাদ
“কে অধিক শক্তিশালী, আল্লাহ নাকি রাশিয়া?’ – আফগানিস্তানে মুজাহিদিনদের অনুপ্রেরনা দিতে গিয়ে আব্দুল্লাহআযযাম।
১৯৭৯ ছিল হিজরী পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম বছর। রাসূল [সাঃ] এর একটি হাদীস অনুযায়ী প্রতি শতাব্দী পর পর আল্লাহ তাঁরপছন্দনীয় ব্যক্তিদের (মুজাদ্দিদ) মাধ্যমে দ্বীন ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত করবেন।
“প্রতি শতাব্দীর শুরুতে আল্লাহ এই উম্মাহ থেকে একজন মানুষকে উত্থিত করবেন যে দ্বীনকে পুনরুজ্জীবিত করবে।” (সুনান আবু দাউদ, কিতাব ৩৭, কিতাব আল মালাহীম, হাদীস নন–৪২৭৮)
১৯২৪ সালে উসমানী খিলাফাতের পতনের পর থেকেই ইসলামের জন্য এক পুনঃজাগরণের প্রয়োজন ছিল । আফগানিস্তানেরবিরুদ্ধে কমিউনিস্ট রাশিয়ার যুদ্ধ হয়ে ওঠে এই বহু প্রতীক্ষিত পুনঃজাগরণের কারণ।
আফগানিস্তানে মুসলিম উম্মাহর এই পুনঃজাগরণ, এই পুনরুত্থান ঘটেছিল দুজন ব্যক্তির মাধ্যমে – আব্দুল্লাহ আযযাম এবং ওসামা বিন লাদেন।
আব্দুল্লাহ আযযাম
আবদুল্লাহ ইউসুফ আযযাম
টাইম ম্যাগাজিন আব্দুল্লাহ আযযামকে অভিহিত করেছিল “ বিংশ শতাব্দীতে জিহাদের পুনঃজাগরনের রূপকার” – বলে।দখলদারিত্বের ভেতরে জীবনযাপন করার প্রকৃত রূপ কি তা ফিলিস্তিনে জন্ম নেওয়া আব্দুল্লাহ আযযামের খুব ভালোভাবেইজানা ছিল। অল্প বয়স থেকেই আব্দুল্লাহ আযযাম ছিলেন চিন্তাশীল এবং কর্তব্যপরায়ণ। এই কর্তব্যপরায়ণতাই তাঁকে উদ্ভুদ্ধ করেছিলো ষাটের দশকে জর্ডান থেকে ইসরাইলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের জিহাদে যোগ দিতে।
কিন্তু তৎকালীন ফিলিস্তিনের বিদ্রোহীদের–এর অধিকাংশই ছিলো জাতীয়তাবাদী, যারা ইসলামকে একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করতো না। আল্লাহ্র ইবাদাত করার বদলে তাঁদের সময় কাটতো তাস খেলে আর গান শুনে। এ সব কিছুই ছিলো আব্দুল্লাহআযযামের অপছন্দনীয়।
একদিন কথাচ্ছলেই তিনি এক সহযোদ্ধাকে জিজ্ঞেস করলেন – ফিলিস্তিনের এই বিপ্লবের ধর্ম কি – যার জবাবে যোদ্ধাটিঅত্যন্ত স্পষ্ট এবং রুঢ়ভাবে তাঁকে জানিয়ে দিলো – এই বিপ্লবের কোন ধর্ম নেই।
এই ঘটনার পরে ফিলিস্তিনের তৎকালীন বিপ্লবের উপর থেকে তাঁর মন পুরোপুরিভাবে উঠে গেলো। তিনি সৌদি আরবে চলেগেলেন সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকতা করার উদ্দেশ্যে।
আফগান জিহাদের ডাক শোনামাত্রই তিনি ছুটে গিয়ে সেই ডাকে সাড়া দিলেন। এবং পরবর্তীতে তাঁর সমস্ত জীবন, তাঁর সমস্ত অস্তিত্বকে উৎসর্গ করলেন মুসলিম উম্মাহকে এই জিহাদের দিকে আহ্বান জানানোর জন্যে। তিনি শপথ করেছিলেন কোন ভাবেই জীবিত অবস্থায় আফগানিস্তানের মাটি ছেড়ে না যাবার। তাঁর আশা ছিলো আফগানিস্তানের মাটিতে আল্লাহ্র আদেশ অনুযায়ী ইসলামীক খিলাফাহ প্রতিষ্ঠা করার অথবা শাহাদাতের।
আফগান জিহাদে যোগ দেওয়ার জন্য সমগ্র বিশ্ব থেকে আগত মুজাহিদদের সাহায্য করা ও সহযোগিতা দেবার লক্ষ্যেওসামা বিন লাদেনের সাথে মিলে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন “বাইত আল আনসার” (সাহায্যকারীদের আবাস)।
আফগান জিহাদের প্রতি মুসলিম উম্মাহকে আহ্বান জানানোর জন্য তিনি ছুটে গেলেন বিশ্বের এক কোণা থেকে আরেককোণায়। সারা পৃথিবী ঘুরে ঘুরে তিনি মুসলিমদের বলতে শুরু করলেন ইসলাম ও মুসলিম ভূমি রক্ষার উদ্দেশ্যে একত্রিত হবার পবিত্র দায়িত্বের কথা। সমগ্র পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো তাঁর জিহাদের দাওয়াত। জিহাদের উপরে তিনি বেশ কিছু বইও লিখেছিলেন – যেমন, Join the Caravan, Defense of Muslim Lands, A Message to Every Youth ইত্যাদি. (তাঁর অনেক বইয়ের বাংলা অনুবাদও হয়েছে)।
এসময় তাঁর বয়স চল্লিশের উপরে হওয়া সত্ত্বেও তিনি সক্রিয়ভাবে সরাসরি আফগান জিহাদে অংশগ্রহন করেন। জিহাদের উদ্দেশ্যে তিনি ছুটে বেড়ান সমগ্র আফগানিস্তান – কখনো পূর্ব থেকে পশ্চিমে, কখনো বা উত্তর থেকে দক্ষিনে। রোদ–ঝড়–শীতকে উপেক্ষা করে– পাহাড় পাড়ি দিয়ে – কখনও ঠান্ডা বরফের উপর পায়ে হেটে, কখনো বা গাধার পিঠে চড়ে। এই দুর্গমযাত্রাপথে অনেক সময় তাঁর তরুন সাথীরা ক্লান্ত হয়ে পড়লেও, কোন ক্লান্তিই আব্দুল্লাহ আযযামকে স্পর্শ করতো না।
আব্দুল্লাহ আযযাম জিহাদ করেছিলেন সম্ভাব্য সবগুলো উপায়ে। তিনি সাড়া দিয়েছিলেন আল্লাহ্র ডাকে –
“তোমরা বের হয়ে পড় স্বল্প বা প্রচুর সরঞ্জামের সাথে এবং জিহাদ কর আল্লাহর পথে নিজেদের মাল ও জান দিয়ে, এটিতোমাদের জন্যে অতি উত্তম, যদি তোমরা বুঝতে পার।” ( সূরা আত তাওবাহ :৪১)
নিজ পরিবারকেও তিনি এই একই আদর্শে গড়ে তুলেছিলেন। এমনকি তাঁর স্ত্রী পর্যন্ত ইয়াতীমদের রক্ষণাবেক্ষণ এবংমানবসেবামূলক কাজের মাধ্যমে আফগান মুসলিমদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
তাঁর কাছে অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরির প্রস্তাব আসলেও তিনি তার সবগুলোই ফিরিয়ে দিতেন। তিনি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন শাহাদাত অথবা শত্রুর হাতে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাঁর জিহাদ থামবে না। এবং তিনি বারবার এই কথা বলতেন যে শেষ পর্যন্ত তাঁর লক্ষ্য হল ফিলিস্তিনকে মুক্ত করা। তিনি সবসময় বলতেন–
“অন্য কোন জাতির পক্ষে কখনো মুসলিমদের পরাজিত করা সম্ভব না।আমরা মুসলিমরা কখনো আমাদের শত্রুদের কাছেপরাজিত হই না। বরং আমাদের পরাজয় ঘটে আমাদের নিজেদের হাতেই।”
ওসামা বিন লাদেন আফগানিস্তানে এসে প্রথমেই আব্দুল্লাহ আযযামের কাছে গেলেন এবং তাঁরা দুজন একসাথে কাজ করা শুরুকরলেন।
প্রথমবারের মতো আফগানিস্তানে আসলেন ওসামা
কৈশোরের শেষ দিকে এসে ওসামা শুনতে পেলেন রাশিয়ানরা আফগানিস্তান আক্রমণ করেছে এবং এর ফলশ্রুতিতে মৃত্যুবরণ করেছে দশ লক্ষাধিক আফগান। এই খবর জানার পর, অন্য আরো অনেক মুসলিম আরবের মতো তিনি আফগানদের জন্যআর্থিক সহায়তা জোগাড় করলেন – এবং তাঁদের সাহায্য করার লক্ষ্যে আফগানিস্তান চলে গেলেন।
ওসামা বিন লাদেন
আফগানিস্তানে তাঁর সাথে দেখা হলো আব্দুল্লাহ আযযামের। আব্দুল্লাহ আযযাম আরব মুজাহিদীনদের থাকা–খাওয়া এবং অন্যান্যসাহায্য–সহযোগিতা করতেন এবং ওসামা সাউদী আরব থেকে এর জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্যের যোগান দিতেন। আব্দুল্লাহ আযযামের উদ্দেশ্য ছিলো আফগানিস্তানের মুসলিমদের রক্ষা করা এবং সেখানে এমন একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যার মাধ্যমে ইসলামের সত্যিকারের পুনঃজাগরণের শুরু হবে। মুসলিম বিশ্বের তাগুত শাসকেরা ১৯২৪ সালে উসমানীখিলাফার পতনের পর থেকেই বিভিন্ন কৌশলে প্রকৃত ইসলামিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকে বাধা দিয়ে আসছিলো – এমনকি সাউদী আরব, যেখানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে শারীয়াহ আইন পালন করা হতো, প্রকৃত পক্ষে ছিলো পশ্চিমা বিশ্বের অধীনস্ত একটি অনুগত দালাল রাষ্ট্র। পরবর্তীতে (২০০০ সাল এং তার পরে) আল কায়েদার মূল লক্ষ্য হল কোন ভুখন্ডে পরিপূর্ণ ইসলামিক রাষ্ট্র (খিলাফাহ) প্রতিষ্ঠার পূর্বে সব ধরনের পশ্চিমা আধিপত্যকে সেই ভূখণ্ড থেকে অপসারণ করা।
যে সময়ের কথা হচ্ছে সে সময়টাতে আমেরিকা এবং সাউদী আরব উভয়ই ছিলো জিহাদের পক্ষে। কারণ আমেরিকার উদ্দেশ্যছিলো সুপারপাওয়ার হিসাবে তাঁদের একমাত্র প্রতিপক্ষ সোভিয়েত রাশিয়াকে যেকোন মূল্যে সরিয়ে দেওয়া। এজন্য যদিগরীব আফগানদের অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দিতে হয়, তাতেও আমেরিকা রাজী ছিলো। এরই ফলশ্রুতিতে আফগানরা গেরিলা যুদ্ধ,বোমা তৈরি, শত্রুর বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কার্যক্রম এবং সমরাস্ত্র ব্যাবহারে প্রশিক্ষণ লাভ করে। কিন্তু যা এই সময়েআমেরিকার জানা ছিলো না তা হলো, এই আফগানদের মাধ্যমেই পরবর্তীতে তাঁদের নিজেদের পতনের সূচনা হবে।
রাশিয়ার পরাজয়
রাশিয়ানদের সাথে মুজাহিদীনের অসংখ্য যুদ্ধ সংঘটিত হয়। জালালুদ্দীন হাক্কানীদের মতো কম্যান্ডারদের কাছ থেকে আমরাএরকম অনেক কারামাতের ঘটনা শুনতে পেয়েছি যেখানে মুজাহিদীনের সম্বল ছিলো ব্রিটিশ আমলের তিনটি রাইফেল মাত্র[যা উনবিংশ শতাব্দীদে ব্রিটিশদের হারিয়ে আফগানরা গানীমাহ হিসেবে পেয়েছিলো ] – এবং এই সামান্য ব্রিটিশ আমলেররাইফেলের একটি গুলিতেই আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলার ইচ্ছায় আলৌকিকভাবে রাশিয়ানদের ট্যাঙ্কগুলো বিস্ফোরিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যেত।
জালালুদ্দীন হাক্কানি
অনেক আফগান কমিউনিস্ট এসব কারামাত প্রত্যক্ষ করার পর দলবল নিয়ে অস্ত্র সহ মুজাহিদীনের কাছে আত্মসমর্পণ করে – এবং তাঁদের সব অস্ত্র মুজাহিদীনের হাতে চলে আসতো ।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যেতো আফগান কমিউনিস্টরা তাঁদের রাশিয়ান প্রভুদের উপর অসন্তুষ্ট।
জালালুদ্দীন হাক্কানী এরকম আরেকটি ঘটনার বর্ণনা দেন যেখানে কম্যান্ডার হাক্কানীর দলের মুজাহিদ এবং আফগানকমিউনিস্টদের মধ্যে যুদ্ধ চলছিলো। যুদ্ধচলাকালীন অবস্থায় হঠাৎ করেই একজন আফগান কমিউনিস্ট গুলি করে তাঁরনিজের কম্যান্ডারকে মেরে ফেললো, এবং তারপর সদলে কম্যান্ডার হাক্কানীর দলে যোগ দিলো। এবং এর মাধ্যমে মুজাহিদীনেরপ্রভাব বৃদ্ধি পেলো।
আফগানিস্তানে সঙ্ঘটিত একটি কারামতের বর্ণনা –
যোদ্ধারা পাহাড়ের চূড়ার মাঝে ছড়িয়ে গিয়ে বিভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করল আর দিন বাড়ার সাথে সাথে দূর থেকে ট্যাংক বাহিনী এর গর্জন শোনা যেতে লাগল। যেই মুহূর্তে প্রথম ট্যাঙ্কটি পাহাড়ের মাঝে সঙ্কীর্ণ গিরিপথের মুখে প্রবেশ করল সে মুহুর্তেআল্লাহু আকবার রব তুলে মুজাহিদীনরা এই ট্যাংক বাহিনীর ওপর গুলিবর্ষণ করতে লাগলেন। যে ট্যাঙ্কগুলো তখনো গিরিপথে প্রবেশকরেনি তাদের ভারী মেশিনগান মুজাহিদীনদের উপর গুলি করা শুরু করল। মেশিনগানের গুলির আওয়াজ আর ছিটকে আসাটুকরো টুকরো পাথরের হট্টগোলের এর মাঝে হঠাৎ করে এক বিকট বিস্ফরণের শব্দে চারপাশ প্রকম্পিত হয়ে উঠল। সবাইঅবাক হয়ে প্রথম ট্যাঙ্কটিকে বিস্ফোরিত হয়ে চারদিকে এর ছিন্নভিন্ন টুকরো গুলোকে ছড়িয়ে যেতে দেখল। আহমাদ গুল তার পুরনো রাইফেল উচিয়ে করে চিৎকার করে বলে উঠলেন “আল্লাহু আকবার। আল্লাহর পাঠানো বিজয় ও সাফল্য চলে এসেছে!”
এবার গিরিপথের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি জ্বালানীঁ ট্রাককে এক রাঊন্ড গুলি এসে আঘাত করল এবং তাতে আগুন ধরে তাকিছুক্ষনের মধ্যে বিস্ফোরিত হল। তা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল আর এর বহন করে আনা গোলা–বারুদের কারণে চারপাশে বিরাট ধ্বংস সাধন হল। এরপর এমন একটি ঘটনা ঘটল যা আগে কেউ ভাবতে পারে নি – সৈন্যরা ট্যাঙ্ক গুলোকে গিরিপথের মুখে ওবাইরে রেখে সেখান থেকে লাফিয়ে বের হতে লাগল আর সেনাবাহিনীর চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল।
লড়াইয়ের শেষ দিকে, যুদ্ধবন্দী হিসেবে নিয়ে আসা ট্যাঙ্কের একজন কমান্ডার জানালো যে তারা ভেবেছিল মুজাহিদীন প্রথমট্যাঙ্কটিকে একটি রকেট দিয়ে আঘাত করেছে। এতে সৈন্যরা যারা গিরিপথের দেয়ালের মাঝে ট্যাঙ্কের ভিতর আটকা পড়েছিলতারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তাই তারা ট্যাঙ্কের উপরের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে এবং মুজাহিদীনদের সাথে গুলিবিনিময় করার জন্য পাথরের পিছে অবস্থান নেয়। এটা ছিল মুজাহিদীনদের জন্য একটা একটা করে শত্রুসৈন্য গুলি করে হত্যাকরার এক সুবর্ণ সুযোগ, কারণ মুজাহিদীনরা ছিলেন প্রকৃতিগতভাবেই নির্ভুল লক্ষ্যভেদকারী।
শত্রুসৈন্যরা পরোপুরি ভাবে পরাজিত হল এবং মুজাহিদীনরা গানীমাহ হিসেবে অসংখ্য অটোমেটিক রাইফেল, মিডিয়াম মেশিনগান, পরিবহন গাড়ি ও ট্যাঙ্ক লাভ করলেন। কিন্তু এই সব কিছুর চাইতে গুরুত্বপুর্ণ ছিল যে তারা আরপিজি–৭ অ্যান্টি আর্মার গ্রেনেড লাভ করেছিলেন। এটা ওই অঞ্চলের যুদ্ধের ধারায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে। এই লড়াইয়ের পরেমুজাহিদীনদের কাছে ট্যাঙ্ক আর আতঙ্কের কোন বিষয় হিসেবে থাকল না এবং তারা অস্ত্রের আক্রমণের বিপক্ষে আরও কৌশলীও দক্ষ হয়ে উঠলেন।
যাবার পথে রাস্তায় প্রবীণ শেখ মাহমুদ লালা জালাল আল–দীন এর কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন, “জালালআল–দীন, আমাকে বল সামনের ওই ট্যাঙ্কটার আসলে কি হয়েছিল?” চিন্তায় নিমগ্ন থাকা জালাল আল–দীন তাকে গভীরভাবে উত্তর দিলেন, “সুবহানআল্লাহ শেখ মাহমুদ, আমি কি আপনাকে বলিনি যে এগুলো হল জিহাদের রহমত। যারা আল্লাহর পথেথাকে আল্লাহ তাদের সাথে থাকেন ও সাহায্য করেন।”
পরবর্তীতে এই দলটিই হাক্কানী নেটওয়ার্ক নামে পরিচিতি লাভ করে এবং একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে সবচেয়ে শক্তিশালীআফগান গেরিলা শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে জিহাদের সময় জালালুদ্দীন হাক্কানী এবং আব্দুল্লাহআযযামের মধ্যে অত্যন্ত অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সমগ্র নব্বইয়ের দশক এবং ২০০০ সাল পর্যন্ত হাক্কানী নেটওয়ার্ক, জালালুদ্দীন হাক্কানীর অধীনেই তাঁদের কার্যক্রম চালু রাখে। পরবর্তীতে বার্ধক্যের কারনে জালালুদ্দীন হাক্কানী – হাক্কানীনেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রন তাঁর ছেলে সিরাজুদ্দীন হাক্কানী, যিনি নিজে একজন মুজাহিদ এবং অভিজ্ঞ যোদ্ধা, তাঁর হাতে সমর্পণকরেন।
শুরুর দিকের তালিবান
রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে জিহাদে ওমরের (এই ওমরই পরবর্তীতে মোল্লা ওমর নামে পরিচিতি লাভ করে) মত অনেক যুবক অংশগ্রহণ করেছিল । এক লড়াইয়ে তার একটি চোখ গুলিতে নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু এটি তার মনোবলে একটুও চিড় ধরাতে পারেনি।
মোল্লা মুহাম্মাদ ওমর
এইসব যুবক ধর্মভীরু পরিবার থেকে উঠে এসেছিল, তাদের শিখানো হয়েছিল কোন আক্রমণকারী সৈন্যবাহিনী যদি মুসলিম ভূমির এক মুঠো পরিমাণ জমিও দখল করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।
এইসব পুরুষ ছিল জন্মসূত্রে যোদ্ধা, দুঃসাহসী ও নির্ভীক। তাদের আরব ভাইদের মত তারাও ইসলাম ছাড়া অন্য কোনজীবনাদর্শের কাছে মাথা নত করতে রাজী নয়, যে ইসলাম আফগানরা আজ থেকে প্রায় ১০০০ বছর আগে নিজেদের জীবনে গ্রহণকরেছে। আফগানিস্তানকে ডাকা হত ‘সাম্রাজ্যবাদের কবরস্থান’। পরবর্তী ৩০ বছরে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর সাথে আফগানিস্তানের যুদ্ধ যেন এই নামটিকে ক্রমাগত পরীক্ষা করতে থাকে।
আফগানিস্তানে রাশিয়া পরাজিত হলো
রাশিয়ানদের শক্তিশালী বিমানবাহিনী আফগানদের বিধ্বস্ত করে ফেলে। তাদের তীব্র গোলাবর্ষণে শহরের পর শহর ধ্বংস হয়ে যেত। রাশিয়ানরা মধ্য এশিয়ায় (আরবিঃ খোরাসান) সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে এবং
তাদের প্রতিপক্ষ আমেরিকানদের সাথে পাল্লা দিয়ে বিশ্বে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য আফগানদের পরাভূত করতে চেয়েছিল।
আফগানরা হিন্দুকুশ পর্বতের পাহাড়ি এলাকায় আশ্রয় গ্রহণ করতো, যা ছিল বিমান আক্রমণের বিপক্ষে এক প্রাকৃতিকআশ্রয়কেন্দ্র। কিন্তু তারা রাশিয়ানদের যুদ্ধবিমানের আক্রমণের বিরুদ্ধে কোন পাল্টা হামলা চালনোর ব্যাপারে অক্ষমছিল।আমেরিকা আফগানদের স্টিংগার মিসাইল সরবরাহ করে, এটা ছিল আধুনিক ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য মারনাস্ত্র যা যুদ্ধবিমান গুলি করে নামাতে পারত। এটা পরবর্তীতে রাশিয়ানদের প্রধান শক্তি বিমানবাহিনীকে ধ্বংস করতে মূল ভূমিকা পালন করে।
আবদুল্লাহ আযযাম এবং ওসামা বিন লাদেন আরব ও আফগান যোদ্ধাদেরকে অবিরাম সাহায্য ও সেবা প্রদান করতে থাকেন।এমনকি তারা নিজেরাও অনেক লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন। বিশ্বপরাশক্তির বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের যুদ্ধে ‘সাহাবাদের সন্তান’ এই আরবদের অংশগ্রহণে আফগানরা অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করতেন।
এসকল লড়াইয়ের সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক কারামাতেরর প্রকাশ হয়, যেমন– পাখিরা মিসাইলের উপরে উড়তে থাকাঅবস্থায় যোদ্ধাদেরকে মিসাইলের গতিপথ সম্পর্কে অবহিত করত, অন্যান্য সময়ে দেখা যেত যে কারো কারো শরীরের উপর দিয়ে ট্যাঙ্ক চলে গিয়েছে বা গায়ে গুলি লেগেছে কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে তারা কোন রকম আঘাত ছাড়াই বেঁচে গিয়েছেন। শহীদযোদ্ধাদের শরীর থেকে স্বর্গীয় গন্ধ বের হত (আরব ও আফগানদের মতে এটা জান্নাতের সুগন্ধ, যেখানে শহীদদের আত্মাএখন বাস করছে)। অপরদিকে শত্রুপক্ষের মৃতদের শরীর থেকে পঁচা গন্ধ বের হত, সেগুলোকে অনেক সময় ফেলে যাওয়াহত এবং লাশগুলো কুকুর খেয়ে ফেলত। (আরও কারামাহ সম্পর্কে জানতে পড়ুন আবদুল্লাহ আযযামের বইঃ “আফগান জিহাদে আর– রহমানের নিদর্শন)।
সরবরাহ পথ বন্ধ করে দেয়ার সমরকৌশল
রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাওয়া আরব–আফগান ইসলামী প্রতিরোধ তাদের শক্তিশালী শত্রুদের পরাজিত করতে একটি নতুন কৌশল শিখে ফেলল। তারা জানত যে আফগানিস্থানে থাকা কমিউনিস্টরা অস্ত্র ও জ্বালানীর যোগানের জন্য পার্শ্ববর্তী মধ্যএশিয়ার দেশগুলো থেকে আফগানিস্তানে প্রবেশ করা সরবরাহ পথের উপর নির্ভর করত। তারা নিরবিচ্ছিন্নভাবে এই পথ লক্ষ্য করে হামলা করতো যাতে করে আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট বাহিনীর অস্ত্র ও জ্বালানীর মজুদ শেষ হয়ে যায়। পরবর্তীতে এটাইকমিউনিস্টদের পরাজয়ের কারন হয়ে দাঁড়ায়। তাদের এই হামলাগুলোর পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে এও দেখা যেত যে অনেকআফগান তাদের কমিউনিস্ট কমান্ডারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করত এবং তাদেরকে গুলি করে চলে আসত।
স্টিংগার মিসাইল ব্যবহার করে রাশিয়ার বিমান বাহিনীকে গুড়িয়ে দেয়া, কমিউনিস্টদের সরবরাহ পথে অতর্কিত আক্রমণ করা,আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট কমান্ডারদেরকে নিজ দলের লোক কর্তৃক হত্যা– এ সবকিছুই রুশ পরাশক্তির ক্ষমতা, মনোবল ওআর্থিক সামর্থ্য ধ্বংসের কারণ হয়ে দেখা দেয়। তারা বিশ্বের দরিদ্রতম এক জনগোষ্ঠির হাতে নিজেদের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করে। এটাই রাশিয়ান সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন (ইউ.এস.এস.আর) ও লাল বাহিনীর শেষের শুরু।
রাশিয়ান সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এই যুদ্ধের পর আর কখনোই পরিপূর্ণ ভাবে পুনরূজ্জীবিত হয়নি। কয়েক লক্ষ আফগান যোদ্ধা ও নিরপরাধ লোকের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আফগানরা ১০ বছর ধরে চলে আসা বহিঃশক্তির কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হল। ২০ বছর পর এই একই সমরকৌশল ব্যবহার করে আফগানরা আরও একবার সাম্রাজ্যবাদী দখলদার পশ্চিমা বাহিনীকে পরাজিত করে।